এক গুচ্ছ কবিতা ।। শুভ্রনীল সাগর

বরষামঙ্গল
অলক্ষ্য কিছু ইচ্ছে এই আষাঢ়ে কাদা হয়ে গেছে!
তারা ধুলো ছিল, উড়ে উড়ে বেড়াত পত্রল সম্মোহনে…

চলতি বর্ষণ বেশি সময় দেবে না।
শ্রাবণে ভেসে যাওয়ার আগেই —
তোমার সঙ্গে কথাগুলো বলে ফেলা দরকার…

৩১ ডিসেম্বর ২০১২
ঠিকানা বদলায়নি —
তবু চিঠি ফিরে আসে!
এই নামে ওখানে নাকি এখন আর
কেউ থাকে না…

তারা নেভে, ধীরে মুছে যায় ফেরার পথ
নিযুত ঘুমবর্ষ ব্যবধানে
ফিরে ফিরে আসা রিপভ্যান উইংকল আমি –
যতসব ব্যবধান, ভাত-টেপা আঠায় জুড়ে
পূর্ণ করি হলদে খাম,
কোনো প্রতীক্ষিত প্রাপক নেই, জেনেও…

মেরুন জার্নাল
তোমার-আমার মাঝে
বয়ে চলেছে অমীমাংসিত তিস্তা…

এই জল উড়ে উড়ে একদিন মেঘ হয়
মেঘের পরে মেঘ
এরও ওপারের ডাকঘরে
জমা হয় আমার রোজকার জ্বর ও যাপন
পুনশ্চে, ভালো নেই – তবু ভালো থেকো!

কবে বিলি হবে চিঠি?
বাইরে নুন-মেশানো ব্যাকুল বারিশ
ধুয়ে দিচ্ছে, ভেসে যায়
প্রাপকের ঠিকানাও কি যাবে মুছে?

চিঠি লিখি, চিঠি যায়
গেলাস বেয়ে নামে নীলচে রাত
জানি, চিঠিতে প্রাপকের অনীহা
তবু খামের উপরে লিখে দিই, “জরুরি”…

দূরের জনপদ
তোমার চোখে বড্ড ভিড়!
তাই ওদিকে বিশেষ যাই না…

ইদানীং খুব বেশি বলতেও ইচ্ছা হয় না আমার।
ধরে নেই, আমি ‘আ’ বলতেই তুমি বুঝে নেবে…

ফেরা
বৃষ্টির জল ঢুকে এলো মনের অন্দরে।
চোখ বোজো, এঁকে দেবো অনিঃশেষ চিৎসাঁতার…

আমরা হাতমুড়ে বসতেই জল জমে গেলো! টুংটাং, কাঁটাচামচে উঠে আসছে সন্ধ্যে।
আরেকটি চামচে ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছি রাত, আর ফট করে ঘোলা হচ্ছো তুমি…

তুমি, আমাদের কথা জানো! জানতে, আমি ঠিকই ভোর অব্দি বসে থাকবো।
কেবল আমার অলক্ষ্য ইচ্ছেগুলো ইলিশের আয়ুর মতন; তাকে জলের কাছে নিয়ে যাও….

দূরত্ব
তুই হাজার বার বললেও, মাঘের নিশুতি অর্থ সেই একই থাকবে। শীতের মন্তাজ বলে যা
তুই পড়াতে চাইলি, তাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে এলো নদী! নদী শুকিয়ে গেলে আমাদের বড় কষ্ট
দিনকে দিন কমে যায় হৃদয়ের নাব্যতা। পলির গুরুত্ব তুই জানিস। তুই এও জানিস, সাব
অল্টার্নে আমার কী ভূমিকা। বরং তোর পুরোনো কোষেরা মরে এলে, খানিকটা পলি মেখে
নিস। কেউ আঁচড় কাটলে, ফুটে উঠবে গাত্রচিহ্ন…

রাস্তাপার আমি একলাই হতে পারি। শুধু মাঝপথে কেউ ছেড়ে গেলে, পথের দুরত্ব আমার
অবাধ্য হয়ে ওঠে….

আত্মজীবনী থেকে
শহরের বালিশগুলো বনশ্রীবিতান থেকে আসে। শহরের সব বালিশ। তুলোভেদে বালিশের
ব্যবহার। তুলো, তুলোকে চেনো না? তুলো; ওই যে উড়ে যাচ্ছিল, যাচ্ছিল যাচ্ছিল
যাচ্ছিল! এমনিতে বালিশ মৃদুভাষী, রাত জেগে পড়ে পরীক্ষা ভয়…

আমার বেডশিটে মেরুন ফুল, ছোপ ছোপ। মাঝে-মধ্যে উল্টে বিছাই।
বেডশিট্ ওল্টালে ফুলেরা ফ্যাকাশে হয়….

কান্না, ছুঁয়ে এসো কেতকী
মৃত্যু কদাচ কথার অবসর আনে। অবসর? আমি অবশ্য অবচ্ছেদ লিখতে চাইব। নারকেল
পাতার ভেতর চাঁদ রাত্রির আগে…

কিছু কথা চিরকাল গলা বেয়ে চোখ, উজানী। বৃষ্টি পুড়ছে বেঘোর। পাখিরা বটগাছে গিয়ে
থামে।‘তুমি-আমি’শব্দেই শুধু কাছে স্বাভাবিক?

ইটস্ কমপ্লিকেটেড
সবকিছু এত প্রকাশিত তবু কোথাও ‘লাইক’ দিচ্ছি না আমি! আমার ইচ্ছে, তোমার আরও
অবচেতন পড়ে ফেলা…

তোমার মৃত কোষ ও টিপ বোতাম তুমি ইমেজ আকারে দিতে পারো; আমি সব ফরম্যাটই
পড়তে পরি। দিন দুয়েক যাক, এত জলদি কীসের? মতামত আমি মনখুশি খিলিপানে সাজিয়ে দেবো…

পাখি উড়ছে, দৃশ্য উড়ছে না
পাখি ও দৃশ্যেরা
আমার নীল দেয়ালে ছায়া হচ্ছে….

অরণ্যের মুখোমুখি
আর আমার শরীর বেয়ে ঝিঁঝিঁ নামে। ঝিঁঝিঁপোকা রাতখেকো, হঠাৎ হঠাৎ ডেকে ওঠে
ডাকনাম। এভাবে চলতে থাকলে আবারও দেখা হবে। যে পথ শহরতলী ছেড়ে হৃদয়ছড়া
গেছে, তার শেষমাথা আমার বাড়ি। এলানো ঘুম, এলানো ক্লান্তি উঠানে ছড়ানো
ভোরবেলা। চিঠি লিখলে আমি উত্তর দিই। বৃষ্টির জলে ধোওয়া ভানুগাছ, লেবুপাতা মুড়ে…

হেঁটে হেঁটে আমি পাহাড়ের কাছে আসি। পাহাড়, নিস্তব্ধ আঁধার ফোঁপানো ইচ্ছেগুলো
লিখে রাখা যায়। তোমাকে বর্ণপরিচয় জানতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। উপপাদ্য
সম্পাদ্য, তাও না। চিরহরিৎ দুঃখরা তো আদর্শলিপি পড়ে না…

তুমি এলে নিয়ে যাব নুড়িপথ। দেখবে, অনেক হাঁটার পর ক্রমশ মুছে যায় পিছুটান…

পর সমাচার, এখানে বর্ষাকাল
পৃথিবীর পথে রয়ে গেছি এতকাল, জেগে। শরীরে অগুনতি চাঁদের ছায়া। হঠাৎ চোখ পড়লে
তাঁতঘর ঠাহর হয়। আজ জল না মুছেই এসে পড়েছি। জলে পদ্ম থাকলে এভাবে ফিরিয়ে
দিত কেউ? চোখে ভিড়, ঘুমের ভেতর সরে যাচ্ছে কাঁথা তুই আর আগের মতো নেই!
আমি বিকল্প বৃষ্টির প্রস্তাব করি…

গেলো আষাঢ়ে যে ডালে ছিল ফুল, আজ কেউ নেই সেখানে! অর্থ হয়, স্বীয় ঝোঁকে ফুটে
ওঠে ফুল। আমার নিভৃত রাত্তির মেখে নিয়ে, ছিঁড়ে দেয় শাখার বন্ধন…

অন্তর্বর্তীকালীন
বড্ড অসহ্য লাগছে পৃথিবীর ভিড়।
তোমার নিঃশ্বাস আলাদা করা যাচ্ছে না…

ভীষণ চেনা পথ বহুদিন পর হাঁটলে রোগাটে লাগে, লতানো।
আমি সেই ধুলো চাই যারা এই আষাঢ়ে কাদা হয়ে গেছে…

সহজিয়া চৈতন্য
পাখিরা দেখতে পেয়ে থামে। সরোবর আর শীতলতা ওদের জ্ঞাত। যেখানে ওদের বসতি,
সেখানে ভয় বলে কিছু নেই। জলের খোঁজ ওরা লুকিয়ে রাখে না। ওদের একটাই মাত্র
জিজ্ঞাসা কতটা আঁধারে তুমি সত্য হয়ে ওঠো?

এবং জীবনের গন্ধ নিয়ে সারি সারি ওড়ে…

এ জার্নি উইথ টু হানড্রেড অ্যান্ড সিক্স বোন্স-১
বলতে দ্বিধা নেই, আমার ঠিকানায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমি তবু দিনের পর দিন
খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে যাচ্ছি! এ মন মধ্যপদলোপী মৃগনাভ পিঁপড়ে যাত্রা কোনো মানে
আছে, থাকতে হয়?

অঘ্রাণে আড়ি পেতে বুঝে নিও খসড়া জীবন। তারাময় ফিস্ ফিস্ যদিও শেখায়নি
চোখটেপা অনুভূতি, কিন্তু তার মানে তো এই নয় আমার টুথপেস্টের মুখটা হারিয়ে যাবে!
যে রাত মশারি টাঙানো, নাক্ষত্রিক নিয়ন আদলে তুমি সেই অকারণ পত্রের প্রথম…

তরুলতা ততোধিক সর্বনাম সহায়, যতটা দেয়াল দ্বিধায় গোলাপি কশেরুকা। গায়ের গন্ধ
তুলে নাও অনার্য পিতা, চাঁদরূপী গাঙুর বানান আমি শিখে নেবো। আপাতত গরু ঘাস
খেয়ে চলে যাক। অবশ্য মাকরিক মনোক্লেশ প্রকারান্তে যতিচিহ্নহীন দ্বিতীয়া প্রণয়, থরো
থরো…
সিরিয়া, তুমি কি অ্যাভাস্ট ইউজ করো?

আন কাট
ভুতুম কুম অভিযানে আমাদের বাঁধাধরা কিছু নিয়ম থাকত – পিস্তলে আওয়াজ হলেই গুলি
খেয়ে লুটিয়ে পড়া। সারেন্ডার করতে আমার মন একদম সায় দিত না, কিন্তু নিয়ম…

নক্ষত্র আমাদের পাড়াতেই থাকে, ও আর্জেন্টিনা। জোল পুকুরে ডুবোডুবির পর রোজ পাড়ে
উঠে বলতো, দেখতো–আমার চোখ লাল কিনা…

ব্যথার মন্তাজ
আঘাতের পেন্সিল নেই
যা লেখার ছেনি ঠুকে, খোদাই।

হৃদয় – জমাট আকর
পথ হারালেও কমা ফেলে যায়।
তুমি, শেকড় পাবে
উতল শেকড় এনে দেবে জল-কাদার খোঁজ…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা
Scroll to Top