১.
নয় বছর বয়সে দেখা পানির হিংস্র রূপটি এই মধ্য বয়স অব্দি তাড়া করে ফেরে। সেবার বিলকুমারী বিল এসে মিলে যায় আমাদের উঠোনে। মাটির বাড়ির পাঁচিলটা খোসা ছড়ানো পাকা আমের মতো টুস করে গলে গেল অদৃশ কোনো মুঠোর আঙুলের ফাঁক দিয়ে। সেই গলে যাওয়া পাঁচিলের ওপারে খেলার মাঠটা যেন একটা দিঘি আর তারও পরে সাধন কাকাদের বাড়িটা একটা দ্বীপের মতো পানিতে ভাসছে। বারান্দার চৌকিতে বসা আমি…। বাড়ির সীমানা ভেঙে যাওয়ায় যুগপৎ ভয় এবং মুক্তির অনুভবে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাই। তো আম্মা-আব্বা ঠিক করলেন আমরা শহরে চলে আসবো দিনকয়েকের জন্য। লঞ্চে বিলকুমারী পাড়ি দিচ্ছি। দুপাশের জনবসতি যেন কোনোকালেই ছিল না। কেবল পানি আর পানি। হ্ঠাৎ দেখি দূরে পারের দিকে একটা বাড়ি ভেসে আছে। কয়েকজন মানুষ ব্যস্তসমস্ত হয়ে ভেতর-বাহির করছে। চোখের পলকে বাড়িটা পানিতে মিলে গেল। চালার টিনগুলো ভাসছে। ওদিকে মানুষগুলো কিছু আর না করার পেয়ে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখে কি পানি ছিল? আজ ভাবি, মনে হয় না। কেননা চোখের পানি যদি বন্যার গতিকে ত্বরান্বিত করে। হয়তো বানভাসি মানুষেরা এত এত পানি দেখে কাঁদতে ভুলে যায় কিংবা সময় পায় না। কেননা ভেবে ওঠার আগেই পানির তীব্রতা অনুভূতির স্তরে পলি জমিয়ে ফেলে। এই পলি বেশ উর্বর। ফলশ্রুতিতে আরেকটি বন্যায় ভেসে যাওয়ার জন্য তারা দ্রুত নিজেদের প্রস্তুত করে ফেলে…
২.
এসব আসলে প্রতিদিনের গল্প। পাল্টায় না। মানুষ যেমন একভাবে রয়ে যায়। মানে পাল্টানোর চেষ্টায় জীবন কেটে যায়। এই উপলব্ধিকে শান দিতে সেদিন ‘দ্য প্লেগ’ নিয়ে বসি। শেষের দিকে এসে চোখ আটকে যায়। দেখি ওরান শহর ছেড়ে মারি চলে যায়। জনতা উল্লসিত। আর এই উল্লাস দেখে রিও বলে :
তিনি বই পড়ে জেনেছেন যে মৃত্যুবাহী রোগের বীজ কোনোদিন মরে না, কোনোদিন একেবারে অন্তর্হিতও হয় না; . . . যুগ যুগ ধরে এ বীজ সুপ্ত অবস্থায় আসবাব আর বিছানাপত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, . . . তারা অসীম ধৈর্য নিয়ে মানুষের ঘরে, নিচের চোরকুঠুরিতে, তোরঙ্গের মধ্যে রুমালে, আর বইয়ের আলমারির তাকে অপেক্ষা করে,- . . . হয়তো আবার এমন দিন আসবে যখন দুর্ভাগ্য মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য এই মারী আবার ঘুম থেকে জেগে উঠে তার বাহন ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে তুলে আবার কোনো আনন্দমুখর শহরের পথেঘাটে মরতে পাঠাবে।. . .
৩.
তো মারি থেকে মানে মারির ভাবনা থেকে মুক্তি খুঁজছিলাম। উপায় হিসেবে কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধুকে ফোন করি। ও পেশায় শুধু নয় নেশায়ও শিক্ষক। আমি পাঁচদিন ঘুমোইনি শুনে এত কষ্ট পেল, আশ্চর্য! বললাম কাল এই পরাক্রান্ত শহরের বুকের ওপর হাঁটবো। শুনে সঙ্গে আসতে চাইল। শিক্ষকরা অদ্ভুত এক সারল্যকে ধারণ করে কিংবা এমন সারল্য যাঁদের মধ্যে থাকে তাঁরাই শিক্ষক হয়। তাই তো এক ধরনের স্নিগ্ধ আলো তাঁদের ঘিরে রাখে। যে আলো চাপচাপ অন্ধকারকেও বোকা বানাতে পারে। আচ্ছা, ওই ছেলেগুলো এই আলো দেখতে পেল না কেন?!
৪.
হয়েছি কি… দিনপাঁচেক আগে জানুয়ারির বৃষ্টিমুখর সকালটা বেশ আয়েস করে উপভোগ করছিলাম। এবং অনুভূতিটাকে ভাষা দেবার প্রবল চেষ্টা শেষতক ব্যর্থ হয়। শীতের মতো গাঢ় অনুভব আর নেই। সবটা নিবিড় হয়ে থাকে তবুও কেমন যেন একটা শূন্যতা পেয়ে বসে। সেটা কাটাতে অলস হাতে পত্রিকা খুলতেই দেখি বড় বড় অক্ষরে লেখা শিরোনাম ‘শিক্ষা নগরীতে অধ্যক্ষ এবং শিক্ষা দুটোরই পুকুরে নিমজ্জন’। সংবাদ সূচনায় লেখা কতিপয় ছাত্রনামধারী যুবক অধ্যক্ষকে তাঁর কক্ষ থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে এনে কলেজের পুকুরে ফেলে দেয়। ভেতরের খবরটা পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। কেমন বিবমিষা পেয়ে বসে…
৫.
আমি প্রতিদিন যে পথটা ধরে কাজে যাই সেই পথের বাম পাশে একটা স্কুল পড়ে। বিশেষ চাহিদাপ্রাপ্ত বাচ্চাদের স্কুল। অভিভাবকরা কেউ গাড়ি করে কেউ অটো করে কেউ রিকশা করে কেউবা পায়ে হেঁটে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলের গেইটে ঢোকে। যেভাবেই আসুক না কেন সবার হাত শক্ত করে বাচ্চার হাতটা ধরে থাকে আর সবার চোখে-মুখে বিষাদের কুয়াশা লেপ্টানো। এরা কেউ কখনো হাসে না কেন? কতবার ভেবেছি হাসি কি এদের জীবন থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেছে নাকি এরা হাসতে ভুলে গেছে? অথচ বাচ্চাগুলোর সরল অভিব্যক্তিতে পৃথিবীর সকল মায়া ঝরে পড়ে…। আচ্ছা, এরা কি কখনো তাদের শিক্ষককে…?
৬.
আমার আশেপাশে এত না! আমি না দিয়ে একটা ঘর নির্মাণ করি। ছাদে শূন্যতা বিছিয়ে দিই। পাশের বাঁশবাগানের ঝিরঝিরে বাতাস ঝরোকা দিয়ে ঢোকে। এলোমেলো শুয়ে থাকা আমার চারপাশে কী এক আকুলতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। সুখ নামক একটা পাখি আমার ঘরের এপাশ-ওপাশ উড়ে উড়ে বেড়ায়। আমার মুগ্ধতার শেষ নেই যেন। সেই মুগ্ধতার পাখায় ভর করে বেরিয়ে পড়ি। পরাক্রান্ত শহরের বুকে হাঁটবো বলে। হাতে সাদা কাগজের প্ল্যাকার্ড। উৎসাহী পথচারী ভ্রু কুঁচকেও কোনো লেখা দেখতে পায় না বলে হতাশ হয়ে পথ ধরে। পাশের জনকে মুখরোচক কিছু বলতে না পারার দুঃখে মুখের পানটা আরও চাপ দিয়ে চিবুতে চিবুতে এগিয়ে চলে। যেন পান নয় সে আমার ধৃষ্টতাকেই চিবুচ্ছে। আমার অবশ্য এতে তেমন একটা খারাপ লাগা কাজ করে না। এতক্ষণ আমার ছায়াটা সঙ্গে ছিল আর দূরে ছিল আমার সেই শিক্ষক বন্ধুটা। ও আমার পাশাপাশি থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করেও কেবল পিছিয়ে পড়ছে। এবং আমাদের দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
৭.
এখন ছায়াটাও আর আমার পাশে নেই। একটা অযাচিত অন্ধকার বিশাল অজগরের হা নিয়ে আমাকে গিলে ফেলতে উদ্যত যেন। তবুও আমি অভ্যস্ত অন্ধের অভিজ্ঞতায় পথ হেঁটে চলেছি। কিন্তু একি! আমার বুকের মধ্যে কিসের ভাঙন চলছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না কেন? এত বাতাস তবু আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে কেন? আমি ভীষণ অসহায় হয়ে নিঃসীম অন্ধকারে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করছি। আমার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে চাবচুব। একজন মানুষের সঙ্গ পাওয়া যেত যদি…। একমুঠো বাতাস আর একজন মানুষের জন্য আমি অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে চলছি। হঠাৎ ধাক্কা খেলাম একটা কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে। দুজনেই পড়ে গেলাম। আমার চোখে সীমাহীন আঁধার বাসা বেধেছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি কোনো এক অতলে সঙ্গে কাকতাড়ুয়াটাও…