(এক)
অতঃপর ইন্দ্রানী আত্মহত্যার শেষ সিদ্ধান্ত থেকে আবারও চ্যুত হলো। অবশ্য এবারের ওর সিদ্ধান্ত চ্যুতির পরিকল্পনা অকারণ অন্তরঙ্গতা-আকীর্ণ উপলব্ধির কারণটাও একটু ভিন্ন ঢংয়ের। কবে কোথাকার কোন এক অসভ্য নাগরিক-সভ্যতার নর্দমার কর্দমাক্ত জীবাণুর মতো উৎসহীন ঈশান নুর বলেছিল-‘ইন্দ্রানীরে গাঙের পানিও সব শুকায় গেল, তুইও কম্যুনিস্ট হই গেলি। ওদিকে সবাই যে খালি চাটছে। তবুও পুরোটাই কম্যুনিস্টের স্যাঁতস্যাতি ধ্বজা উড়োয়ে দিলি’-নবদ্বীপ হাটের নতুন রাজাকার চেয়ারম্যান ঈশান নুরের ব্যঙ্গ মিশ্রিত তিরস্কার।
সহ্য করতে পারেনি ইন্দ্রানী। মুহুর্ত কয়েক বিব্রত বোধ করেছিল মাত্র। সামান্য এক চিলতে কপালে দু’তিনটে অসামান্য রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল দ্রুত। কপালের সাথে যোগাযোগ করে চোখ দুটো যেন ছোট হয়ে এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই। শুধু চোখের তারা দুটো যেন হঠাৎ করেই দপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভে গিয়েছিল ক্যামেরায় তীব্র জ্বলে ওঠা ফ্ল্যাশের আলোর ঝলকানির মতো। ঠাস করে একটা শব্দ ম্লান অন্ধকারকে সঙ্গে সঙ্গেই দুর্বোধ্যভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছিল যেন। হাতটা দ্রুতই এসে পড়েছিল ঈশান নুরের গালে। একেবারে তামাটে হয়ে যাওয়া কুচকুচে কালচে গালের উপর। এতে ঈশান নুর চমকে ওঠেনি। আশ্চর্যও হয়নি- দেখছিল শুধু ইন্দ্রানীকে। অপলক দৃষ্টিতে নয়- পিটপিট করে। জিহ্বাটা বেরিয়ে এসেছিল ঠোঁট দুটিকে ভিজিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু ঠোঁট ভেজাতে পারেনি। শুকনোই থেকে গিয়েছিল।
আর দাঁড়ায়নি ইন্দ্রানী। সোজা চলে এসেছিল নিজ ঘরে। ঘরে ঢুকেই শুকনো বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি ভাঙ্গাচোরা টং জাতীয় একটি বস্তুর উপর শতছিন্ন কাঁথা দিয়ে মোড়ানো বিছানা নামের অসহ্য একটা অত্যাচারের কাছে অবলীলায় সমর্পণ করেছিল নিজেকে। প্রচণ্ড উত্তেজনার আকর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যই বোধ করি এপাশ ওপাশ করেছিল কয়েকবার। তারপর একেবারে শ্রাবণের সাথে একাকার। তা হয়তোবা বোধগম্যতার বাইরে এক ধরনের অর্থহীন ব্যর্থ অভিসারের ফলাফলের মতো। অবশেষে অনেকক্ষণ ধরে নীরবেই কেঁদেছিল ইন্দ্রানী। পাশ ফিরে সোজা চিত হয়ে চোখের দৃষ্টি বিস্তৃত করে দিয়েছিল হোগলার চালার অসংখ্য ফুটোয়। আটকে গিয়েছিল সে ফুটোগুলোয় টুকরো টুকরো খণ্ড খণ্ড অসংখ্য ঈশান নুরের বিবর্ণ মুখ। চোখ দুটোকে ঝাপসা করে তুলেছিল। ইন্দ্রানীর অসংখ্য বুকচেরা আকুলি বিকুলি বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল আবার ইন্দ্রানীর কাছেই ঐ টুকরোগুলোর সাথে। শেষ উত্তর যা পেয়েছিল তাতে অবশিষ্ট আর কিছুই ছিল না। সব শুন্য হয়ে গিয়েছিল। কেমন যেন একটা অবজ্ঞার চাকচিক্য ঝলসে উঠেছিল উত্তরের সবটা জুড়ে।
-‘ইন্দ্রানীরে মেলেটারিরা আমার চোখের পর্দা খুইলি দি গিছে। রাজাকারের রাইফেলটাই আমারে নবদ্বীপহাটের চিয়ারম্যান কইরে দিতি পেইরিছে। কিন্তু তুই যে একেবারে পুরোটাই কম্যুনিস্টের ক্ষ্যাত হইয়ে গেলি’
– কি কইলা? তালি আমারে কম্যুনিস্টের ক্ষ্যাত বানাইলো কিডা? আর আমিই বা ক্ষ্যাত হয়ে গেলাম ক্যান। আমার উদ্ধার?’
– ইন্দ্রানী অসহায় আক্রোশে চিৎকার করে উঠতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই ঐ টুকরোগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নির্ঝরের মতো নেমে আসতে শুরু করেছিল ওর চোখের পাতায় অমৃতের জোয়ারের মতো ইন্দ্রের আধ্যাত্মিক রাজনীতিকে সাথে নিয়ে। ঈশান নূর যেন এ কথাটিই বলতে চেয়েছিল- ‘সমাজতন্ত্রের ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরে নিজেরে সমর্পণ করো, উদ্ধার তিনিই কইরবেন।’ বুঝতে পেরেছিল ইন্দ্রানী। শেষে এক সময় নিজেই থামিয়ে দিয়েছিল নিজের সে কান্নাকে। উঠে বসেছিল বিছানার ওপর। স্বাধীনতার বুকভরা নিঃশ্বাসের মতো দৃষ্টিকে সীমার বাইরে ছড়িয়ে দিয়ে উচ্চারণ করেছিল মাত্র দুটি শব্দ। জিভের লালা দিয়ে ভরে যাওয়া চকচকে পুরুষ্ঠ ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে ঝিকঝিকে দাঁতের ডগা ছুঁয়ে বেরিয়ে এসেছিল। ‘আত্মহত্যা- আর না’।
বেরিয়ে পড়েছিল ইন্দ্রানী ঘর ছেড়ে। একটা দারুণ ক্রোধের সাথে রক্তারক্তি কিছু অভিমানের বেদনাকে মিশিয়ে দিয়ে একটা বিশাল অহংকারের সাথে প্রতারক কিছু অমর্যাদার তীব্রতাকে জড়িয়ে নিয়ে ওর নিজের মানুষ ইন্দ্রের খোঁজে। অনেক আগে থেকেই খুঁজে চলেছে ইন্দ্রানী ওর ইন্দ্রকে ওর অবসেশনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু সেখানে কখনই খুঁজে পায়নি তাকে। কিছু গাঢ় দ্বিধাহীনতায় ভুগে চলেছে সে। রেখে যাচ্ছে শুধুু দগদগে আর কিছু অসম্ভব গাঢ় ক্ষতচিহ্ন তার সারা শরীরের আনাচে কানাচে। ক্লান্ত রক্তের কোষে কোষে টকটকে তাজা টসটসে ইন্দ্রানী হয়ে ওঠেছিল রোদের দেবার আগে চিপে নেয়া ভিজে কাপড়ের মতো। ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার শক্তিও যার ছিল না। অথচ সেই ইন্দ্রানী আজকে যেন বড় উদ্ধত । সব খোঁজাখুঁজি শেষ হয়ে গেছে তার। অথচ এ মুহূর্তটিতেই ওর কেন যেন মনে হলো সে যেন খুঁজে পেয়েছে তার ইন্দ্রকে। দাঁড়িয়েছে একেবারে ইন্দ্রের মুখোমুখি। আজকে হলদে ভোর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবার সামান্য আগেই দাঁড়িয়েছে একেবারে ইন্দ্রের মুখোমুখি। প্রচণ্ড বেগে হেসে উঠতে চেয়েছিল ইন্দ্রানী। হেসেছিলও, কিন্তু শব্দের ক্ষীণতায় নিজেই কেঁপে কেঁপে উঠছিল সে বারবার- ভয় পেয়ে গিয়েছিল হয়তো বা শক্তির দৈন্যতায় এ ক্রুদ্ধ হাসিই আবার কান্নার ভেতরে ডুবে যাবে মুহূর্তে। ভীষণ কষ্ট সহ্য করেও সংবরণ করে নিয়েছিল নিজেকে ইন্দ্রের সামনে। একেবারেই ওর চোখের তারায় রক্তবর্ণ দুটি চোখ রেখে। কতকটা যেন অতি ঘোর অনিবার্য এক বিধ্বংসী দুঃসাহসে ভর করে। স্বপ্নটা দপ করে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গিয়েছিল মুহূর্তে।
(দুই)
‘অই ছিনাল মাগী। ঘুম যে ভাংতিছে না বড়। রাতের বেলা কি গতরটারে মেইলে ধইরে সইন্যেসীগের আসন পেইতে গিছিলি? নাকি ঢলোঢলো অঙ্গের উপর দে আবার ব্যাধের কাফেলা পার হইয়ে গেছে ? ও-তো আবার তোর মধ্য রাইতের শাকভাত।’ – দুর্গাদাসের গলা। কিছুুটা জড়ানো হলেও বড় খটখটে আর নির্মম। কথাগুলো কানে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর। ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল অনেক আগেই কিন্তু বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা করেনি। একটা তন্দ্রার মতো নরম আচ্ছন্নতা যেন জড়িয়ে রেখেছিল ওকে কেমন একটা মসৃণ পেলবতা দিয়ে। বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিল ইন্দ্রানী। আর ওর সেই দুর্বলতার ভেতর দিয়ে কেমন যেন এক অদ্ভুত ধৃষ্টতার ছায়াও পড়েছিল ওর সব আচ্ছন্নতাকে ডিঙ্গিয়ে হৃৎপিণ্ডের রক্ত কণিকায়। নিশপিশ করছিল প্রতিটি আঙ্গুলের ডগা। তীক্ষ নখের তীব্র আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল ইন্দ্রানী নিজেকে। রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল ইন্দ্রানীর হৃৎপিণ্ড থেকেও।
ক্ষরিত সে রক্ত ধারার স্রােতে কঠিন মাটির গভীরতাকেও দীর্ণ করে একটা আগুনের শিখা যেন বেরিয়ে আসছে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ইন্দ্রানীকে সংহার করবার জন্যেই সম্ভবত। ভয়ে কুঞ্চিত হয়ে গিয়েছিল সে। সেটে গিয়েছিল লবন দেয়া কেঁচোর মতো। মুখটা আপনাআপনি বেঁকে গিয়েছিল ওর। রক্তশূন্য রোগীর মতো সাদা দেয়াল হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রানীর ভরপুর চোখমুখের বিলোল লাবণ্য। চিৎকার করে উঠেনি তাও। শুধু গলে গিয়ে দলা পাকানো মোমের মতো কুকড়ে গিয়েছিল। ইন্দ্রানীর ধারনা হয়তো আত্মসংহারই ছিল তার অনিশ্চিত আর অস্বচ্ছ ভবিষ্যতের জন্য মোক্ষম। অথচ সে প্রয়োজনবোধ করেও সে প্রয়োজনের মূল্য দেয়নি। কাকে যেন পাবার এক প্রবল আকাক্ষায় বিচলিত আর সম্মোহিত করে ফেলেছিল ওকে। কিন্তু কে সে? সেই কি ঈশান নুর? প্রথম প্রেম। ইন্দ্রানীর ইন্দ্র।
‘কইরে ইন্দ্রানী। কানের পর্দার ফটকের তালা মেরে দিছিস। সোহাগের ডালাটা ইট্টু খুইলে ধরে উদ্ধার কইরে দে দয়া কইরে।’ – দুর্গাদাসের বিশ্রী তিরস্কার।
– ‘সোহাগের ডালার মুখ খুলে দিছি বইলেই না কাত্তিকের হিজরে কুত্তার মতো ঝুইলে পড়া জিভ টান করে নালানর্দমা খানাডোবা সব একাকার কইরে শুইকে বেড়াচ্চো। নিজের মাগরে সুখ দেবার মুরোদ নেই তার আবার কস্তুরির সুবাস নেয়ার মাতামাতি। আমি রইছি বইলেই তো সাড়ে তিন পহর পার না হতিই ন’কোশ, ছ’কোশ কত্তি পারতিছো । শরম মরদের বালাই, চণ্ডালের পাপ আর শুদ্রের জ্বালা।’ – কথাগুলি বলে হাঁপাতে থাকে ইন্দ্রানী। একটা বেগবান জীবনের নিরন্তর প্রবাহ যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের শিথিল উপলব্ধিটা তরান্বিত হয়ে ঘণিভূত হতে থাকলো। উঠে দাঁড়ালো সে। ক্ষণ কয়েক কি যেন ভেবে নিল। এদিক ওদিক দেখলো কিছুক্ষণ। আর সময় নেই তার। এবার ছুুটতে হবে বুঝতে পারলো সে। আর এবারের এ ছুটে চলা হবে বিরামহীন, যতিহীন এবং অবিশ্রান্ত।
ইন্দ্রানীর বুকের ভেতর বাতাসের বান ডাকলো। ভাতের শূন্য থালায় আরশোলা তাড়ালো ডান হাতের তর্জুনী দিয়ে সে। বালিশের উপরে টিকটিকি দেখেও দেখলো না ইচ্ছে করে। পা বাড়ালো জীবনের প্রথম সংসার নামের যুথবদ্ধ পিচপিচে কালাজ্বরের চৌহদ্দির বাইরে। ঘৃণায় ছোট্ট কপালের ঠিক কেন্দ্রে একটা চিহ্নের উদ্ভব হলো। সিদ্ধান্ত ঘন দুধের ঘনত্বের চাইতেও দৃঢ় হলো। ইন্দ্রানী বুঝতে পারলো সময় ফুরিয়ে গেছে। আর এখানে নয়। যে সিদ্ধান্তটি সে বাতিল করেছিল সে সিদ্ধান্তেই আবার ফিরে যেতে চাইলো ইন্দ্রানী। আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটিই এই মুহূর্তে বড় কাছের মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেল। বড় উপযোগী মনে হল আত্মহত্যাকে।
চন্দ্রদ্বীপ আর কত দূর? যাবার সময় শুধু বলে গেল ‘তোমার সংসারের কপালে আগুন। ঈশ্বর আমার মাতাই থাক।’দূর্গাদাস ঈষৎ হাসলো। কোন প্রতিক্রিয়া হলো না দুর্গাদাসের ভেতরে বাইরে। ইন্দ্রানী নিজেও বুঝতে চাইলো না তার পুরোটা । শুধু বুঝলো ঐ হাসিটি বড় অবজ্ঞার, বড় ঘৃণার এবং আরোও বড় আত্মদম্ভের বুঝিবা। লক্ষ্য করল ঐ হাসিটির উপরেই মুদ্রিত একটি তিরস্কারের ঈঙ্গিতকেও।
-যেতিছ যাও। তবে মুখের আগুনে এ দুর্গাদাস পাড়ই অমৃতের সমান। ’
ঘর ভেঙ্গে গেল দুর্গাদাসের। চলে গেল ইন্দ্রানী। দুর্গাদাসও আর মনে করলো না ইন্দ্রানীর মতো নিছক একটা নারকী পাপাত্মার জন্যে তিলমাত্র কালক্ষেপণের মধ্যে কিছুমাত্র যথার্থতা অথবা পুরুষতা আছ। প্রতিদিনের অভ্যেস আর নৈমিত্তিক নিয়মের সূত্র ধরে জুতো, চটি মেরামতের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামাদির বেঢপ দড়ি বাঁধা কাঠের বাক্সটাকে বাঁ কাঁধের উপর ফেলে দু’ঠোটের আঠালো কোনায় ছোট্ট একটা আধ পোড়া বিড়ির চুপসে যাওয়া গোড়াটাকে ঠেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো দুর্গাদাস নবদ্বীপ হাটের পথে। খালি পা, ধুতির প্রান্তটি হাঁটু অবধি, উদোম গা।
এই নবদ্বীপ হাটেই প্রথম পরিচয় ইন্দ্রানীর সাথে দুর্গাদাসের। এবং শুধু পরিচয়ই নয় সাথে সাথে পরিচয় থেকে সরাসরি একেবারে ঘরে তোলা পর্যন্ত। পরিচয়ের ঘটনাটি অবশ্য ঘটে যায় কোন এক ভিনদেশী গৃহত্যাগী যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারীর সৌজন্যে কিছুটা আকস্মিকভাবেই। এবং তার চাইতে বেশি আকস্মিকভাবেই নির্দেশটাও আসে যোগীর কাছ থেকেই ইন্দ্রানীকে সরাসরি দুর্গাদাসের ঘরে তুলবার। দুর্গাদাসের ভাববার আর কিছু ছিল না। ঈশ্বর আশির্বাদ ভেবে ঢিপ করে যোগীর দুটো পায়ের লম্বা পাতায় আরো লম্বা একটা প্রণাম ঠেকিয়ে ওরই সামনে ওরই উচ্চারিত মন্ত্রের শুদ্ধাশুদ্ধ অনুকরণ করে ইন্দ্রানীকে তুলে নিয়ে গেল দুর্গাদাস ওর হোগলায় ঢাকা ভাংচুর শোবার ঘরের নোংরা কাথার চাইতেও ভাংচুর বিছানার মাঝখানে। যোগীরও দৃশ্যান্তর ঘটে গেল এরপর। যাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি কখনোই -কোনদিনই। এই যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারীই তার যৌন ক্ষুধা মিটিয়েছিলে ইন্দ্রানীকে ভোগ করে। যোগীর ‘তন্ত্র বলে’ ঈশান নুরকে পাইয়ে দেবে এ আশ্বাসকে বিশ্বাস করেই নিজের দেহটিকে অকাতরে উপায়হীনভাবে মেলে ধরেছিল ইন্দ্রানী যোগীর লোভের আগুনে পুড়ে ছোট হয়ে যাওয়া লাল টকটকে চোখদুটির সামনে।
‘বুঝলি ইন্দ্রানী’ কিছুটা সাহসে ভর করে এগুবার চেষ্টা করে দুর্গাদাস। ‘তোকে আমি জানতাম মিছে বইলে আর পাতকি হবার ইচ্ছাও নেই এই বয়েসে- মাঝেমাঝে হোগলার ফুটো, ফাঁক দে তোরে আমি দেখতামও’।
চুপ করে থাকে ইন্দ্রানী। শুধু চোখের কোণে একটা নেতানো মেয়েমানুষী ঋতুকালীন সংকীর্ণতায় ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে, চোখের কোণ দুটি চিকচিক করে বুঝিবা। পরমুহূর্তেই ভিজে যায় গাল দুটি। ইন্দ্রানী ভাবতে থাকে অতীত, হঠাৎ করেই চলে আসে একেবারেই স্মৃতির প্রথম পাতায়। নববধূ ইন্দ্রানী। জীবনের প্রথম বিয়ের সলজ্জ্ব কনে। এ সময় ঝগড়াঝাটি নাকি বড় কুলক্ষণের। দুর্গাদাস কিন্তু থামে না। ইন্দ্রানীর নীরবতায় আরো বেশি করে সাহসী হয়ে ওঠে। অনর্গল অর্গল ভেঙ্গে কথার ইন্দ্রজাল রচনা করে।
‘তা একদিক দিয়ে আমার জন্যি হইছে বলতি হবি। ইন্দ্রের জন্যে ইন্দ্র ইন্দ্র কয়ে বুক ফাটায়ে সেই যুদ্ধের ঘোর তাণ্ডবের মধ্যেই একবার মেলেটারি ক্যাম্পে ঢুকতে পারলিই তো আর আজকের এই বহু কর্ষণে চিড় ধরা জীর্ণ বস্ত্রের মতো দিশী সমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত হয়ে ফিরতি পারতিসনে। মিলেটেরিরাই তোরে উদ্ধার কইরি দিতো। সাথে সাথে আমার ইচ্ছের ডগাডাও চাক্ষুস তুই পর্যন্ত ঠেকতি পারতো না’ একটু থেমে আবার শুরু করে – ‘ঈশ্বর মঙ্গলময় শুন্য কানে আর আঙ্গুল ঠেলতে হবি নে। সাক্ষাত ভগবান নিজেই দূত হয়ি নিজের হাতে ধইরে এনে সইন্যেসী বাবারে দিয়ে তথাস্তু কইরে তোরে একেবারে আমার ঘরে তুইলে দিয়ে গেলেন। নইলে কোথায় কবে কে শুনিছে – ডোমের ঘরে কুলিনের ফুল শইয্যে’।
এতোগুলো কথা একসঙ্গে বলে একটু জিরোতে চাইলো দুর্গাদাস। এমনিতেই গঞ্জিকাসেবী তার উপর আবার খাদ্যের অভাব। সেই সাথে মাঝেমধ্যেই উপোষের জ্বালা। তার সঙ্গে আবার চিরায়ত দৈহিক উত্তেজনার পীড়ন, অনাচারের মতো প্রাত্যাহিক ব্যাপারগুলি ছায়ার মতো লেগে থাকা আদিকালের অভ্যেস। রেগে উঠে ইন্দ্রানী- ভেতরে ভেতরে অতিমাত্রায়। রক্ত বর্ণে সমস্ত মুখমণ্ডল লালচে হয়ে যায় এবং আরো গভীরতর হতে থাকে। ইন্দ্রানী বোঝে না সমাজতন্ত্র কী? অথচ ঐ একটি মাত্র শব্দতেই বড় ক্ষোভ, বড় ঘৃণা আর অসম্ভব আক্রোশ তার। সাথে আরো বড়ো মাত্রার মিশ্রিত অভিমান। কিছুতেই সহ্য করতে পারে না তা। কোন কারণে কেউ কোথাও সে কথা উচ্চারণ করলে আর তা ইন্দ্রানীর শ্রবণ পর্যন্ত কোন ক্রমে পৌঁছলে বড় কষ্ট হয়। বালির সৌধের মতো বর্তমানটা ওর দরদর করে ভেঙ্গে পড়ে চোখের সামনেই। বড় কাছাকাছি চলে আসে ইন্দ্র- ইন্দ্রের ঘনিষ্ঠ চিনচিনে উপলব্ধি।
আর সন্ন্যাসী বাবা! গৃহত্যাগী যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারী। সে তো এক মহাঘোর কৃষ্ণপক্ষের থমথমে মধ্যযামের রতিক্রান্ত অশ্বযুথভ কদাচিৎ আবার যৌগিক প্রতিক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া সমুদ্র তলদেশের উত্তাল তাণ্ডবের মতো- যে তাণ্ডবের বিকীর্ণমান অগ্ন্যুৎপাত আবার শেষ পর্যন্ত প্রশান্ত জলধির উপরিস্তর থেকে স্বভাবতই দৃশ্যমান হয় না – জলের প্রতিভায়।
‘মেলেটারি! ওরে জলধর, ইন্দ্ররে ধইরি নি’ গেল’। লুঙ্গির কাছায় কোমর বেঁধে উঠে পড়ে দৌড়ে চিৎকার করতে থাকে ইয়াকুব। ওকে অনুসরণ করে জলধর।
‘ওতো ধরবেই। ভরা প্যাটে উপোষের ঢংয়ে- সমাজতন্ত্রের ধ্যাড়া পিটোলি রাইজ্যের রাজা কি আর ঠিক থাকতি পারে।? ইট্টু, আট্টু গৌরচন্দ্রিকা তো থাইকবেই। সমাজতন্ত্র!’- ইয়াকুবের কথারস উপর ঘৃণার থু-থু ছিটায় জলধর।
বাবাও আর অদৃশ্য আর অনিশ্চিত ঈশ্বরে ভরসা খুঁজবার মতো সঙ্গত কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। জাগতিক লোটাকম্বলের প্রয়োজনই প্রত্যক্ষ বাস্তবতা। টোল খেতে খেতে বাবাই সামলে নিলেন ইন্দ্রানীকে। প্রায় মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা। এই ‘বাবা’- নামের বস্তুটি হলো সেই যোগী অমৃতলাল ব্রহ্মচারী। প্রায় মুর্ছা যাওয়া ইন্দ্রানীর শরীরী উত্তাপ যেন তার সব যোগীত্বকে নিঃশেষ করে দিলো। পরিবর্তিত করে দিলো এক উচ্চকামী লোভাতুর হ্যাংলা পাপাত্মায় । পিপাাসার্ত অঙ্গের তৃষ্ণা আত্মাকে যে বড় বিচলিত করে। চিন্তান্বিত হলেন বাবা। ঘোর কাটিয়ে অভিভূত। দূর লোকালয়ের ঘন বসতি ভাঙ্গা মরাকান্নার জরো প্রলাপ, গাছগাছালির পত্রপল্লবে ভর করে ক্রমাগত আঁছড়ে পড়তে থাকলো সন্ন্যাসী বাবার শ্রীচরণ যুগলে। হাড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়া নবদ্বীপ হাটের শ্মশান শূণ্য শিরিষ গাছের পাতার শিরশিরে ভয়ের নিভাজ ত্রাস। রগে রগে ছত্রাকার। ‘তৃষ্ণায় জলপান ঈশ্বরের নির্দেশ’। ফিশফিশিয়ে বলেছিল ব্রহ্মচারী । নিঃশ্বাস ঘন আর ভারী হয়ে এসেছিল ব্রহ্মচারীর । বলেছিল – ‘জলপান কর । ঈশ্বরই উদ্ধার কইরবেন’। তার নবদ্বীপ হাটের জনশুন্য প্রাণহীন একটি ভাঙ্গা ঘরের নোংরা আর ঠাণ্ডা মেঝে থেকে ইন্দ্রানীকে নিয়ে গিয়েছিল সন্ন্যাসী বাবা তার কুলুঙ্গির আশ্রমে। সেখানেই সন্ন্যাসী বাবার দুটো প্রসারমান শক্ত হাতের এড়ো কব্জিতে বিঁধে গেল ইন্দ্রানী। আত্মহত্যায় নিমগ্ন হলো সে।
এরপর যখন বেরিয়ে এলো ইন্দ্রানী সন্ন্যাসী বাবার কুলুঙ্গি আশ্রম থেকে তখন আত্মহত্যার প্রথম সিদ্ধান্তে বড় বিধ্বস্ত ওর দেহী চৈতন্য। যার তুলনা দ্বীপহীন দ্বীপান্তরে আসার শুন্যতা জড়ানো হাহাকারের অন্য নাম। দৌড়ুতে শুরু করলো প্রথম ইন্দ্রানী আক্রান্ত তাড়নায় আহত লীলাবতীর ঝিলমিল লজ্জ্বা ভেঙ্গে। সামনেই জলাঙ্গীর জল। কিন্তু হলো না। চ্যুতি ঘটলো প্রথমবার। সব গোলমাল করে দিল ঈশান নুরের কল্পচিত্র। জলাঙ্গীর সব জলে দোলায়মান ও পাড়ের মিলিটারী ক্যাম্প, ওখানেই এখন ঈশান নুর। ইন্দ্রানীর ইন্দ্র, ব্রহ্মাণ্ডটা বড় ছোট। ইন্দ্র কি বাঁচবে- আর?
পা বাড়ালো ইন্দ্রানীর জলাঙ্গীর ওপাড়ে মিলিটারি ক্যাম্পের দিকে। এতটুকু বিচলন ছাড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলো না সেখানে। ব্রহ্মচারীই প্রথম ভোগ করেছিল ওকে। তারপর তুলে দিয়েছিল দুর্গাদাসের হাতে।
‘ইন্দ্র যে আর নেই। মেরে ফেলাবেনে ওরে মেলেটেরিরা।’ – তিন কুল শুন্য ইন্দ্রানীর বিলাপ। অনুসন্ধানেই উদ্ধার। ‘ঈশ্বর আদেশ লংঘন করে আমিতো পাতকি হতি পারিনে’। নিঃশব্দে একটু হাসে দুর্গাাদাস। আরোও একটু ঘনিষ্ঠ হতে চায়। ইন্দ্রানীর দেহভাণ্ডারেই খুঁজে পেতে চায় দুর্গাদাস তার ঈশ্বরকে।
‘বুঝলি তখন মনে হইতো জীবিতকালে তোর এ কৃষ্ণের শ্যামশোভা দেহভাণ্ডে নিজের স্থান কইরে নেয়া আর তীর্থে ভক্তের মরণে তিল মাত্র ব্যবধান নাই। আর পরকালে? সে তো তোরও জ্ঞান গম্যের মধ্যেই- ডোমের ইচ্ছেয় ঈশ্বরের কানেও আগুনের তাপ উটে আসে। ’
এবার একটু শব্দ করেই হাসে দুর্গাদাস। হাসির শব্দটায় একটা ফাঁসফ্যাঁসে জাতীয় অতি শব্দ ক্রিয়াশীল থাকে শেষ পর্যন্ত। ইন্দ্রানী কিছু বলে না। পায়ের নখে মাটির রক্ত ঝরায়। মিলিয়ে যাবার আগে হাসির সরু লেজটাকে আকড়ে ধরে আবার বলে দুর্গাদাস। কিন্তু শব্দটি থেকে যায়।
‘মানে- তুইও যদি কোনরকমে সেভাবে এট্টু নষ্ট টষ্ট হইয়ে যিতি পারতিস’। এ নষ্ট হওয়ার আকাক্ষার নেপথ্যে কাজ করে দুর্গাদাসের আর্থিক অচ্ছলতা। ইন্দ্রানী খারাপ হয়ে গেলে সে তার দেহটি বিক্রি করে কিছু বাড়তি রোজগার করতে পারতো।
চমকে উঠে আবার দীর্ঘদিনের অভ্যাসলব্ধ শক্তি দিয়ে কোনরকমে সামলে ওঠে ইন্দ্রানী। সহ্য করে নেয় শান দেয়া কথার ছুরির আঁচড়টাকে। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হয়ে যায় উত্তরটাই দিয়ে দেয় যথাযথ -‘তালি অন্ততঃ মরণ চিতেয় আগুন দেবার শেষ ভরসা একটা জোটানো যায়।’ কিন্তু আর এগুলো না ইন্দ্রানী। জিভটা শামুকের মতো গুটিয়ে নিল মুখের খোলসে। দাঁতের ধার দিয়ে ঋতুবতী মেয়ে মানুষের নেতানো সংযমিতা দিয়ে নিজের ঠোঁট কাটে। যত কিছুই হোক ইন্দ্রানী আজকে নববধূ। জীবনের প্রথম বিয়ের লজ্জায় লজ্জিত লীলাবতী। এ সময় ঝগড়াঝাটি করতে চায় না ইন্দ্রানী। এ সময়ে ঝগড়াঝাটি নাকি আসলেই অলক্ষণে- আর এটিই সত্য বলে মনে হয় তার কাছে অন্তত এই মুহূর্তে।
কিন্তু দুর্গাদাস জানতো না যে ইন্দ্রানী ইতোমধ্যে অন্যের ভোগের বস্তু হয়েছে। কিন্তু ইন্দ্রানী আর নিজেকে তৈরি করেনি ওর ইন্দ্র- ঈশান নুরের জন্যে। ভালবেসেছে কিন্তু কখনোই আর নিজের করে পেতে চায়নি। ইন্দ্রানী বুঝে নিয়েছিল এবং মাঝে মাঝে নিজেই আনমনে ফিসফিস করে উচ্চারণও করতো – ‘এই দেহটা দিয়ে তো আর ইন্দ্রের পুজো হবি নে। হে ঈশ্বর ইন্দ্ররে তুমি বাঁইচে রেকো।’ আর তখনই দুর্গাদাসের কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে। কি যেন বলছে অত্যন্ত ককর্শ কন্ঠে দুর্গাদাস। কিন্তু তা গ্রাহ্য করলো না ইন্দ্রানী।
(তিন)
সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা রাজনীতির মর্ম আর অর্থনীতির সূত্র- এসবের কিছুই বোঝে না ইন্দ্রানী, বুঝবার কথাও নয়। শুধু বোঝে যুদ্ধ আর শেখ মুজিব। সবার কাছে যেমন ইন্দ্রানীর কাছেও তেমনি শেখ সাহেব। শেখ সাহেবই যুদ্ধটা বাঁধিয়েছে। নইলে শুন্য থালার নষ্ট এনামেলে উপোসী মুখের ফ্যাকাশে ছায়াতেও ছিল অপার সুখ। তারপরেও অন্তরের অতি নিভৃত কোণে সযতনে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠা করেছিল শেখ সাহেবকে ইন্দ্রানী। বড় ভালো লাগতো মানুষটাকে। কেন ভালো লাগতো তা জানে না ইন্দ্রানী। তবে ভালো লাগত ভীষণ। নবদ্বীপ হাটের কোলাহলের চূড়ায় থোকা থোকা জটলার বিদ্বেষের মেলায় ঈশান নুরের ছায়া যখন পড়ে – ইন্দ্রানীর বড় ভালো লাগে দুর্ভিক্ষের হাটে আকালের সন্ধান করতে। ক্লান্তি আসে না, শুধুই ভাবতে ইচ্ছে করে ঈশান নুরকে – ওর একান্ত নিজের ইন্দ্রকে। ইন্দ্র তো তারই। বুকটা প্রচুর নিঃশ্বাসের জায়গা দিতে পারে না। থিক থিকে স্বপ্নের কাদায় ভরপুর হালকা ফুসফুসের ছোট্ট চত্বর।
লোকে বলে- ‘নির্ঘাৎ নরকবাস’।
‘রাজার বিরুদ্ধে প্রজার আস্ফালন। এ যে বিলক্ষণ লয়ের লক্ষণ।’ শিরাগুলো টনটনে ছিঁড়ে গেলেও ইন্দ্রানী তখন গভীর আত্মমগ্নতায় ইন্দ্রের কথায় অবিচল সান্তনা পায়।
‘এ দেশটার কিছু হবেনারে ইন্দ্রানী। মানুষগুলি সব চামারের পোনা। খালি পাকিস্তানী মেলেটারির জুতোর শুকতলা চেটে, চেটে নিজেদের ছিরাদ্দ ডাইকি আনে।’
‘চাটপি নে! ভাতই পায় না যে।’- ইন্দ্রানীর নির্লিপ্ত ছোট্ট উত্তর। পেটের নাড়ীতে আকুলিবিকুলি পাক খায়। ঝট করে তেতে উঠে ঈশান নুর।
‘ভাতের থাল কে কবে কার জিভের ডগায় তুইলি দিছে? ও কাইড়ি নিতে হয়।’
‘শক্তি থাকলিতো!’- খিলখিল হাসিতে ভাংতে থাকে ইন্দ্রানী। ভাংতে ভাংতে একেবারে ঈশান নুরের দেহের সাথে লেপ্টে যায়। আদর করে না ঈশান নুর। চোখের তারা দুটো শুধু অন্তর কাঁপায়।
‘ এ সমাজটারে উল্টোয়ে দিতি হবি রে ইন্দ্রানী। নইলে বাঁচতে পারবিনে। তুইও না, আমিও না। ’
আবারও হাসে ইন্দ্রানী।
‘কি যে কও তুমি বকা খাওয়া জোরো রোগীর মতো। মাথার ঘিলু গুলোন সব পইচে গেছে তোমার। এর চে ভাল দেয়ে আমাগের কুনো কাম আছে, না ও আমাগের কপালে সয্য হবে?’
অতি ঘোর ক্ষুব্ধ চেতনায় কাঁপতে কাঁপতে ধুকপক শব্দ তুলে পাকস্থলীর অতল থেকে ফিসফিস নিস্তরঙ্গ অথচ হড়হড় করে কি যেন একটা বেরিয়ে আসতে চায় ইন্দ্রানীর পেট থেকে । গলগল করে বমি করে ঈশান নুরের পায়ের কাছে। বমি শেষে অসহায়ের মতো তাকায় ঈশান নুরের দিকে অপলক। কিছুটা সময় নিয়ে সামলে নেয় নিজেকে। শাড়ীর আঁচলের কোনা দিয়ে মুখটা মুছে নেয়। তারপর আবার বলে-‘তার চে চল একখানা চালা বান্ধি। পায়ে পায়ে টিপে, টিপে আসতিছে তো আর একজন। জায়গা কইরে রাইখতে হবিনে এখুনি?’
আচমকা আড়ষ্ঠতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায় ঈশান নুর। নিগুঢ় নিস্তব্ধতায় সিসে ঢালে দু’কানের দু’পর্দায়। অন্ধকারের ডানার নিচে অদৃশ্য হয়ে যায় নবদ্বীপ হাট। ভারী বাতাসে হোঁচট খায় ঈশান নুরের কণ্ঠস্বর।
‘এ সমাজে নোতুনের জায়গা হয় না রে ইন্দ্রানী। ওর জন্যি চাই আর এক নতুন সমাজ। হাতুড়ি আর শাবলের ঘামে ডুইবে থাকা কিছু নেই। এর মইধ্যেও সমান ভাগেভাগ করা সবকিছু থাকার উদোমতন্ত্র।’
‘সেইটে আকার কি রকুম সমাজ?’ ছোট্ট প্রশ্ন ইন্দ্রানীর। ‘সেইটে তো আসল সমাজ। যারে বড় বড় বুদ্ধিঅলা লোকেরা কয়-সমাজতন্ত্র। যে সমাজে তুমি আমি সবাই সুমান। নোতুন কেউ আসতি চাইলে জায়গা আগেই কইরে রাখা হয়।’
‘তালি সমাজতন্ত্রের সেই দুনিয়াটা তোমার বানাতিছোনা কেন? সেটি হলি তো এই হা-ভাত আর যমভাত আর থাকে না। ’
‘সেই চেষ্টাই তো তলেতলে আমরা সব্বাই কইরতিছি। সেইটের জন্যেই তো আইকের এই যুদ্ধ। এত রক্তের ধারা। ’
‘কিছুই হবে না । ওরে নষ্ট কইরে ফেলতি হবে’
আঁতকে উঠে ইন্দ্রানী-
‘ কি কও ? আমি বাঁচবো কেমন কইরে?
‘ক্যান? আমারে নিয়ে । যারে এই সমাজে জায়গা দিতি পারবিনে তারে আইনে কি করবি? তার চে মমতা জাগানের আগেই নষ্ট কইরে ফালানেই কি ঠিক না? যদি কুনুক্রমে একবার সমাজতন্ত্রটিরে আনতি পারি তালিতো আর অভাব বইলে কিছু থাকবি নে। তখন তো একটা ক্যান পাঁচটা আসলিও বাঁচায়ে রাখতি পারব।’
‘সত্যই, সত্যি কথা কচ্ছো?’
‘ক্যান, আমার ভালোবাসায় তর বিশ্বাসের অভাব আছে?’-দৃঢ়তায় পৃষ্ঠ ঈশান নুরের পাল্টা প্রশ্ন।
ঈশান নুরের বুকে মুখ লুকিয়েছিল ইন্দ্রানী। অনেক আদর করেছিল ঈশান নুর ইন্দ্রানীকে। সেদিনই নিধু কবরেজের কাছ থেকে ছ’টাকা পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে ওষুধ এনে নষ্ট করে দিয়েছিল ওর পেটের সন্তানকে। এরপর অনেকদিন প্রচণ্ড কষ্ট করেছিল ইন্দ্রানী। রক্তক্ষরণ হয়েছিল অপরিমিত। সে সময় প্রচুর সাহায্য করেছিল ঈশান নুর। সবসময় কাছে কাছে ছিল ইন্দ্রানীর। দুজনের ভালোবাসা আরও গভীর থেকে গভীরতর হয়েছিল ওদের মধ্যে। ঈশান নুরের বলা-‘সমাজতন্ত্র’- কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিল সে।
এরপর ঈশান নুরের ঐ উদোমতন্ত্রের শ্রুতিটিই লোকে লোকে, কালে কালে ধাবিত হয়ে সমাজতন্ত্র নামের দু’বেলা পেটপুরে খাবার বর্নিল বস্তুটি নবদ্বীপ হাটের উপোসি মানুষগুলোর কাছে বহু বিস্তারে বর্ণিত হয়ে গিয়েছিল বিচিত্র পথে। লোকে জানত এবং বিশ্বাস করতো ঈশান নুর সমাজতন্ত্রের মানুষ। মাটির নিচে ওর সব কাজ কারবার। ঈশান নুরের কথাতেই এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা ইন্দ্রানী ওর সমাজতন্ত্রের প্রখর উদ্দীপনা। দেশটা এবার আর উদ্ধার না হয়ে যাবে না কিছুতেই। এরই ধারাবাহিকতায় বোধকরি মাঝেমধ্যে কিলবিল করে তেড়ে আসে উদোম গাঁয়ের ছেলে ছোকড়াদের চিৎকার করা মিছিল । ভাঙ্গাচোরা ফেস্টুন, উচ্ছ্বাস আর অস্থির কোলাহলে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে যায় সব। হাসির বুদ্বুদ ওঠে ইন্দ্রানীর তলপেট মুচড়ে দিয়ে।
‘উদোমতন্ত্রের শাস্ত্রী সেপাইদের উপোসের কাল এইবার কাটাইল বইলে।’ তিতেটে ঢেকুর গিলেও অঘ্রাণের বিকেলের এক ফোঁটা রোদের অনিবার্য একটি ‘সুখবৃত্ত’ রচনা করে ইন্দ্রানীর একরতি চোখের তিরতিরে দুটি কৃষ্ণকালো উজ্জ্বল তারায়। ঈশান নুর তো এ তন্ত্রেরই নেতা। পরপরই নিজের ভেতর কেন জানি আবার আতঙ্কের উতুঙ্গ বিবমিষা আলোড়ন তোলে । ‘অলক্ষুণে একাত্তরটা যদি সকালের আগেই বেঘোরে নিপাত যাতি পারতো !’ আবার নিষ্প্রাণ হয়ে যায় ইন্দ্রানী। উজ্জ্বল কালো চোখের তারা দুটো থেকে এক এক করে সব আকাক্ষার আলো আবার নিভে যেতে থাকে।
অবোধ্য, অসম্পূর্ণ বিশাল বোধের চরাচরে একটি ছিদ্রহীন অসম্পূর্ণতা যেন নির্জন নিশ্চেতনতার গহীন গাঙ্গে চেতনার সুতো কাটে- নোংরা গোবরে পোকার চি-র-র, চি-র-র শব্দ তুলে। পাজরের নীচে আকন্ঠ নিমজ্জমান ধুকধুকে হৃৎপিণ্ডটা শ্বাসকষ্টে চিরে চিরে যায় বেধড়ক কুঁকড়ে যাওয়া বিশ্রী শব্দের ঘুর্ণিপাকে নীলাভ কুয়াশার চড়ানো ধোঁয়া আর সেই নীল আগুনের মিহি শিখার ডিগবাজীর শব্দে ডুবতেই থাকে ইন্দ্রানী অজ্ঞাত এক আশঙ্কার খণ্ড খণ্ড ঝোপঝাড় দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে। নবদ্বীপ হাট দোল খায় আকাশচারী মুলি বাঁশের সরু কঞ্চির ডগায়। উৎরাই ভাঙ্গা বাঁধের চিক চিকে বালির জ্যোৎস্নার অন্ধকার থমকে দাঁড়ায়। চকচকে বর্ষার তীক্ষ ফলায় ঈশান নুরের মাথাটা গোটা চরাচরকে একাকার করে ফেলে। প্রহর ঘোষণায় উচ্চকিত শেয়ালকুলের একত্রিত অবিরাম শব্দবান হুড়মুড় ধাক্কা খেয়ে ডানা মেলে দেয় যেন আরও দূর, বহুদূর শুন্যালোকের জমাট বাধা অখণ্ড নিস্তব্ধতায় । কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে নিস্তব্ধতার চিড় ধরা ফাটল থেকে তাড়িত হয়ে সেই নীল আগুনের মিহি শিখা মাটির ওপরের সবুজ ঘাসের আকাশমুখী ডগায় নীল আগুনের ফুলকি হয়ে সে মিহি শিখা আর নীল কুয়াশার ফেনিল বুব্ধুদ ঢেউহীন সমুদ্রের প্রশান্ত জলের মতো নিঃসীম চেতনাহীনতার ডিঙ্গিতে আশ্রয় খোঁজে।
‘বাতাসের তোড় সব থাইমি গেল ক্যান? কইলজের ভেতরটা ফাইটে যায় যে।’
– নিজেকে প্রশ্ন করে কোন উত্তরই খুঁজে পায় না ইন্দ্রানী। নীল কুয়াশার ছোপছোপ ফেনা আর নীল আগুনের মিহি শিখার মুখোমুখি ডিগবাজীতে – সমাজতন্ত্রের ক্ষরিত রক্তে ভাসতে থাকে ইন্দ্রানীর সুখ আর সুখের সব অলীক কল্পনা। ইন্দ্রানীর অন্তরটি হয়ে যায় ক্ষোভ আর অভিমান মিশ্রিত ঘৃণার ভাগাড়।
বুদ্ধির ঝিল্লিপুঞ্জে পাক খেতে খেতে লন্ডভণ্ড হয়ে যায় চৈতন্যের ধবল লাশ। অপসৃয়মান প্রকৃতির জন্মান্ধ বস্তনিচয়ের প্রগাঢ় উৎকণ্ঠায় ঠুকে গিয়ে চুরমার হয়ে যায় মিলিটারি ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে হঠাৎ করেই নবদ্বীপ হাটের চেয়ারম্যান হয়ে যাওয়া ইন্দ্রানীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন , ইন্দ্রানীর একান্তই আপনার ইন্দ্র- রাজাকার ঈশান নুর। এই কি সেই ঈশান নুর! নাকি ঈশান নুরের অবাস্তব বীভৎস, বিকৃত প্রতিমূর্তি – ঈশান নুরের ছায়ার জান্তব শরীর। রাজাকার ঈশান নুরের সমাজতন্ত্রী রাজনীতির আধ্যাত্মিক উচ্চারণ ‘সমাজতন্ত্রে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরে নিজেরে সমর্পন কর। উদ্ধার তিনিই করবেন।’
ইন্দ্রানীকে গ্রহণ করতে চেয়ারম্যান ঈশান নুরের সরাসরি অস্বীকৃতি। দ্রুত পায়ে দৌড়ে কোনোরকমে পালিয়ে এসেছিল ইন্দ্রানী ঈশান নুরের সামনে থেকে। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল চিৎ হয়ে। হোগলার চালার অসংখ্য ফুটোয় আটকে গিয়েছিল টুকরো টুকরো অসংখ্য ঈশান নুর। অসংখ্য বুক চেরা আকুলি বিকুলি ইন্দ্রানীর বারবার এ টুকরোগুলির সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল ইন্দ্রানীর কাছেই। উত্তর যা পেয়েছির তাতে অবশিষ্ট আর কিছুই ছিল না। সব শুন্য হয়ে গিয়েছিল। কেমন একটা চরম অবজ্ঞার চাকচিক্য ঝলসে উঠেছিল ঈশান নুরের ঐ উত্তরের সবটা জুড়ে।
ইন্দ্রানী আশ্চর্য হয় না। রাজাকার চেয়ারম্যান এ ঈশান নুর তো তার সেই সমাজতন্ত্রী ঈশান নুর নয়। এ ঈশান নুর তো পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের সাক্ষাৎ প্রেতাত্মা। অথচ এই ঈশান নুরের সমাজতন্ত্রের আওড়ানো বুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেই হয়ে গিয়েছিল ঈশান নুর কথিত সমাজতন্ত্রের চরম শিকার। ‘সমাজতন্ত্রে সকলের অধিকার সমান’- ঈশান নুরের এই কথাটির সত্যতা খুঁজে পেয়েছিল ইন্দ্রানী শুধু তার শরীরটার উপর ভোগ করবার সকলের অধিকার সমানভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রটিতে। আর কোথাও নয়। সবশেষে আশ্চর্যতম বিষয় নবদ্বীপ হাটের উদোমতন্ত্রী হাজার হাজার উপোসী মানুষের জমাটবদ্ধ শ্লোগানে তীব্র চিৎকারে আর তাদের হাতে রক্ষিত তীক্ষ বর্শার ফলায় আমুল বিদ্ধ ঈশান নুরের নিষ্প্রাণ দেহটা খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছিল ইন্দ্রানী। চিৎকার করে ওঠেনি ইন্দ্রানী, কাঁদেওনি শব্দ করে। শুধু দু’ফোটা করুণার অশ্রু ঝরে পড়েছিল ওর দু’চোখের কোণ বেয়ে। এই হাজার হাজার উপোসী মানুষের জমাট বাঁধা শ্লোগানের চিৎকারে ইন্দ্রানীর অতি তীক্ষ কন্ঠস্বরটি শুধু হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হারিয়ে যায়নি ওর হাতে রক্ষিত অতি ক্ষুদ্র বর্শাটির তীক্ষ ফলাটি।
পরদিন দেখেছিল ইন্দ্রানী জলাঙ্গীর তীরে বালুচরের জ্যোৎস্নার চিকচিকে বালির গভীরে অর্ধেক সেঁধিয়ে যাওয়া ঈশান নুরের মাথাটি। আর সেই নীল কুয়াশার ছোপছোপ ফেনিল বুদ্বুদ আর নীল আগুনের মিহি শিখার একত্রিত প্রচণ্ড উল্লাস। ক্রমান্বয়ে কুয়াশার সেই নীল রং আর নীল আগুনের মিহি শিখা শুন্যালোকের অসীম স্বাভাবিক নীলের সাথে আরো নীলাভ হয়ে যেতে থাকে।
জোড়া লাগা ঠোঁটের রেখায় ঝড় ওঠে ইন্দ্রানীর। ছিঁড়ে যায় অতি মসৃণ আর পাতলা ঠোঁটের পরত। ফিসফিস করে শব্দ হয় ঠোঁটের চড়ায়। সেই পুরনো শব্দ- ‘তালি আমি একাই সমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত হইয়ে গেলাম ক্যান?’
আত্মহত্যা করা হয় না ইন্দ্রানীর। ডুবতে থাকে সেই ছোপছোপ নীল কুয়াশার অসংখ্য বুদ্বুদের অতলান্ত থেকে অতলান্তে। ‘ইন্দ্রানীরে মেলেটারিরা আমার দু’ চোখ খুইলি দি গিছে। মেলেটারি ক্যাম্প থেকে ওগের দেওয়া রাইফেলটাসহ রাজাকার হইয়ি না ফিরলি আজ আমি কি আর নবদ্বীপহাটের চিয়ারম্যান হতি পারতাম? কিন্তু তুই যে একেবারে পুরোটাই কমুনিষ্টের ধ্বজা উড়োয়ে দিলি। আমি অনেক ভেবে দেইখছি – ও বড়ই স্যাঁতস্যাতে। তাই আর ভিজে কাঁথা গায়ে জড়াতে চাইনি। সোজাসুজি রাজাকার হইয়ে ফিরে আইসি এই নবদ্বীপ হাটের চিয়ারম্যান হইছি। আসলে নবদ্বীপ হাটের মানুষগুলি বড় বেশি ভালো। আমারে ঠিকই চিনে নিছিল। তা না হলি আমারে কি আর রাজাকার জাইনেও এই নবদ্বীপ হাটের চিয়ারম্যান বানাতো!’
এতোগুলি কথার উত্তরে ইন্দ্রানী শুধু দুটো প্রশ্ন করেছিল-
‘তালি আমারে তুমি সমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত বানাইলে ক্যান? ক্যান আমি সমাজতন্ত্রের ক্ষ্যাত হইয়ে গেলাম?’- উত্তর শোনার জন্যে আর দাঁড়ায়নি ইন্দ্রানী। শুধু নিজের দুটি হাতের তালুর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ, দেখছিল হাত দুটির তালুতে, আঙ্গুলের ডগায় আর নখের গভীরে রক্তের ছাপ এখনও আছে কি না। এরপর এক অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিল ইন্দ্রানী। যেন অনন্তকালের এ যাত্রা। যার কোন শেষ নেই। চলতেই থাকবে ইন্দ্রানীর প্রতিহিংসা আর আত্মহননের অভিলাষের ওপর আত্মপ্রতিষ্ঠার অহংকারের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে আপন অন্তর্লোকে অন্তর্গত হয়ে অবিশ্রান্ত। অপার মহাশুন্যের সীমা ছড়িয়ে যাওয়া অসীমতার কোন শেষ নেই যে। প্রকৃতই আছে কি?